সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে দৈনন্দিন পরিমিত ফলের ন্যায় সবজি গ্রহণের বিকল্প নেই। বিভিন্ন রকমের সবজি গ্রহণ আমাদের পুষ্টি পুরণে অন্যতম সহায়ক। প্রয়োজনীয় পুষ্টি ব্যতীত কেউ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে না। দুর্বল ব্যক্তি সমাজে ও পরিবারে কোন অবদান রাখতে সক্ষম নয় আবার বোঝাও হতে পারে না। স্বাস্থ্য যেমন-সকল সুখের মূল, তেমনি পুষ্টি জাতির উন্নতির মূল চাবিকাঠি। শাক-সবজি ও ফলমূল আমাদের শরীরের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন- ভিটামিন ও খণিজ লবণের প্রধান উৎস। উদ্যানতাত্তি¡ক ফসলের মধ্যে সবজি অন্যতম পুষ্টি যোগানদাতা এবং বাংলাদেশ বিশে^ প্রাথমিকভাবে ফসল উৎপাদনে ১৪তম ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৭.৫৫ লক্ষ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১১৪ লক্ষ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয় যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এছাড়াও, সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে এসব সবজির একটি বিরাট অংশ নষ্ট কিংবা অপচয় হয়। অথচ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ ফলমূল ও শাক-সবজি সারাবছর আমাদের নিকট সহজলভ্য হয় না। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় উৎপাদিত বিশেষ করে অধিকাংশ শাক-সবজি মাঠ থেকে সংগ্রহের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সাধারণত ৩ থেকে ৫ দিনের বেশি সতেজ ও খাবার উপযোগী থাকে না। এর প্রধান কারণ হলো শাক-সবজির দ্রুত পচঁনশীলতা।
অপরপক্ষে, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য আমাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় প্রয়োজনীয় সবজি রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত সবজির প্রাপ্যতা প্রতিজনের জন্য দৈনিক ২০০ গ্রাম যা প্রয়োজনের মাত্র ১/৫ ভাগ। আবার ভরা মৌসুমে অধিক পরিমাণ শাকসবজি উৎপাদিত হওয়ায় যথাযথ সংরক্ষণ সচেতনতা ও প্রক্রিয়াজাত জ্ঞানের অভাবে সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে অপচয় প্রতিনিয়ত অপচয় বা নষ্ট হচ্ছে। এক সমীক্ষায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমাদের দেশের উৎপাদিত সবজির অপচয় হচেছ মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ যা টাকার অংকে শুধু সবজিতে ৮-১০ হাজার কোটি টাকা বা তারও বেশি (হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, ২০২২ ও বিএআরআই প্রতিবেদন, ২০২৩)। ভরা মৌসুমে সবজির দামও অনেক কম থাকে এবং কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যও পায় না। অনেক সময় উৎপাদন খরচও উঠে না বলে জানা যায়। এতে করে কৃষক উৎপাদনে মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে এক মৌসুমে একই ফসলের মূল্য কম আবার পরের বছরে একই ফসলে অধিক উৎপন্নের কারণে মূল্য বেশি হচ্ছে। ফলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পুষ্টি পেতেও দেশবাসী বঞ্চিত হচেছ।
শীতকালীন এই শাক-সবজিকে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের আওতায় আনা হলে সবজিতে যেমন মূল্য সংযোজিত হবে তেমনি কর্মসংস্থানের পথও তৈরি হবে। কৃষিপণ্য যেহেতু অধিক পঁচনশীল কাজেই প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য সারা বছর সরবরাহ করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে উৎপাদিত ফল ও সবজির মাত্র শতকরা ১ ভাগ দেশের শিল্প কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় যা উন্নত দেশের তুলনায় অতি নগন্য। গ্রামের লোকজনদেরকে প্রক্রিয়াজাতকরণের উপর প্রশিক্ষণ দিতে পারলে একদিকে যেমন শাক-সবজির অপচয় রোধ হবে অন্যদিকে পুষ্টিও সংরক্ষণ হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠি তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘঠাতে কিছুটা হলেও সক্ষম হবে। পারিবারিক পর্যায়ে শাক-সবজিতে মূল্য সংযোজনের বিভিন্ন সহজলভ্য পদ্ধতি রয়েছে। সহজাত প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ফসলের অপচয় অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
শাক-সবজি ৬-৮ মাস স্টীপিং পদ্ধতিতে সংরক্ষণ এবং পরবর্তীতে আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, শুকনো পণ্য ইত্যাদি বাসা-বাড়ীতে অনায়াসে অল্প খরচে তৈরি করা যায়। স্টীপি দ্রবণে সবজির মধ্যে গাজর, ফুলকপি, বাধাকপি, শসা, টমেটো, মটরশুটি, করলা, ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ ইত্যাদি এককভাবে অথবা মিশ্র সবজি হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে লবণ সংরক্ষক, খাদ্যের রুচিকর সুগন্ধ দান ও স্বাদ বর্ধক হিসেবে কাজ করে। লবন, হলুদের গুড়া, গøাসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড ও পটাসিয়াম মেটাবাইসালফাইট (কেএমএস) নির্দিষ্ট অনুপাতে পানিতে মিশিয়ে সংরক্ষক দ্রবণ তৈরি করা যায়। মিশ্র সবজি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রথমেই পরিপুষ্ট মিশ্র সবজি যেমন-গাজর, ফুলকপি, শসা, ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ, শিম ইত্যাদি সংগ্রহ করে ভালভাবে ধৌত করে নিয়ে তা পুরো বা কয়েক টুকরো কেটে বøাঞ্চিং বা হাত সহনীয় গরম পানিতে ২-৩ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে অথবা ভাব দিতে হয়। প্রয়োজনে কিছু সাইট্রিক এসিড বা লেবুর রস অথবা কেএমএস (০.৫ গ্রাম/লিটার) যুক্ত করা যেতে পারে। অত:পর স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। এখন একটি পাত্রে স্টীপিং দ্রবণ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে শতকরা ৫ ভাগ লবণ, শতকরা ০.৩ থেকে ০.৫ ভাগ গøাসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড ও ০.৫-১ গ্রাম/লিটার হিসেবে কেএমএস য্ক্তু করতে হবে। প্রয়োজনে লবণের দ্রবণটি ছেঁকে নিতে হবে এবং সংরক্ষক পাত্রটি ভালভাবে গরম পানি দ্বারা জীবাণুমুক্ত করে পাত্রে বøাঞ্চিং করা মিশ্র সবজি বা সবজির টুকরোগুলো ভর্তি করে স্টীপিং দ্বারা পূর্ণ করতে হবে। লক্ষণীয় যে, পাত্রের ভিতর সবজিগুলো যেন পুরো ডুবো অবস্থায় থাকে এবং পাত্রের উপরিভাগ পর্যন্ত লেগে না থাকে। পরিশেষে পাত্রের মুখ ভালভাবে আটকিয়ে প্রয়োজনে টেপ লাগিয়ে দিতে হবে যাতে পুরো বায়ুরোধী হয়। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রেখে তৈরি করতে হবে। প্রক্রিয়াজাতকৃত সবজি শুষ্ক ও স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়। ব্যবহারের পূর্বে স্টীপিং দ্রবণে রাখা সবজি ভালভাবে কয়েকবার পানি দ্বারা ধৌত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণে বের করে নিয়ে পুনরায় ভালভাবে পূর্বের নিয়ম রাখতে হবে। আবার মিশ্র সবজি দ্বারা খাদ্য দ্রব্য তৈরির সময় লবণ পূর্বের তুলনায় কিছুটা কম দিতে হবে।
মিশ্র সবজি আমাদের সকলের খুবই প্রিয়। এটি সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। উন্নত দেশে মিশ্র সবজি খেয়েই অনেকে দুপুর বা রাত্রের খাবার সম্পূর্ণ করে থাকে। কিছুটা ভাব দেয়া বা হালকা সিদ্ধ করে তাতে সামান্য লবণ ও মিশ্র মসলা যুক্ত করে খাওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন মিশ্র সবজি দিয়ে আচার বা চাটনী তৈরি করলে তা সহজেই ভাত, খিচুড়ী, বিরাণী, পোলাও এবং অন্যান্য খাবারের সাথে যুক্ত করে খেতে অনেকেই পছন্দ করে। এটি তরকারীর বিকল্প হিসেবে যেমন খাওয়া যায় তেমনি মুড়ি, রুটি, পরোটো, তন্দুর, পাপড়, লুচি, পুড়ি, সিংগারা, সমুচা, কাবার, ভেজিটেবল রোল, বার্গার, ন্যুডুল্স ইত্যাদির সাথে খেতে ভালো লাগে। মিশ্র সবজি দিয়ে আচার তৈরি করার সময় শুরুতেই মিশ্র সবজি হিসেবে প্রতি কেজি হিসেবে ৩০০ গ্রাম ফুলকপি, ২৫০ গ্রাম গাজর, ১৫০ গ্রাম শিম, ১৫০ গ্রাম ক্যাপসিকাম, ১০০ গ্রাম বেগুণ, ৫০ গ্রাম মটরশুটি ভালভাবে ধৌত করে হালকা সিদ্ধ করতে হবে। অত:পর মিশ্র সবজির টুকরোগুলো গরম সরিষা বা সয়াবিনের (৪০০ মিলিলিটার) তেলে ভেজে নিয়ে তাতে পরিমিত পরিমাণ আদা (৬০ গ্রাম) ও রসুনের (৩০ গ্রাম) পেষ্ট নিয়ে হলুদ (১০ গ্রাম) ও মরিচের (৩০ গ্রাম) গুড়ো যুক্ত করে কষাতে হবে। কষানো তেলে সামান্য পরিমাণ (৫০-৭৫ গ্রাম) কাঁচা মরিচ যোগ করা যেতে পারে। কষানো সম্পন্ন হলে ভাজা মিশ্র সবজি যুক্ত করে তাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চিনি (১৫০ গ্রাম), সরিষা (২০ গ্রাম), মেথি (৫ গ্রাম), জিরা (৩ গ্রাম), পাঁচফোড়ন (২ গ্রাম), কালিজিরা (২ গ্রাম), লবণ (৩০ গ্রাম) ও ধুনের (৩ গ্রাম) গুড়া যোগ করে ভালভাবে মিশাতে হবে। পরিশেষে পিএইচ এর মাত্রা ও টক-মিষ্টির সমতা যথাযথ রাখতে এবং অণুজীবকে প্রতিরোধ করতে পরিমিত পরিমাণ অ্যাসেটিক এসিড (৮-১০ মিলিলিটার) যুক্ত করতে হবে। সিরকা বা ভিনেগার যুক্ত করলে যথাযথ পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। রান্না করা মিশ্র সবজির আচার ভালভাবে ঘন হয়ে আসলে জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতল বা বয়ামে ভর্তি করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শুকনো জায়গায় অনায়াসে গুণগতমাণ বজায় রেখে বছরব্যাপী সংরক্ষণ করা যায়।
বর্তমানে বিশে^র প্রায় ৪০ টি দেশে আমাদের উৎপাদিত ১৫০ ধরণের উপর ফলমুল ও শাক-সবজি রপ্তানি হচ্ছে এবং রপ্তানি বৃদ্ধির যথেস্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজনীয় পরিচর্যার ব্যবস্থা, সংরক্ষণাগার ও স্থানান্তর ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মোড়কজাত দ্রব্য সহজলভ্য করা হলে উন্নত দেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য পণ্য বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের ৩টি দেশ সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েত। ওমান, কাতার, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ অন্যান্য দেশেও কিছু পরিমাণ রপ্তানি হচ্ছে এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত আচার, চাটনী, সস, জুস ইত্যাদির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত তরুন, যুবক ও নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বাণিজ্যিক কৃষি শুরু করেছে। তাদেরকে অধিকতর প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা গেলে একদিকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে অন্যদিকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাশিপাশি পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতেও অবাদান রাখবে নি:সন্দেহে। আবার, মানসম্পন্ন কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করা হলে রপ্তানি বাজার যেমন বড় হবে তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে।
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১, ই-মেইল: ferdous613@gmail.com

বাংলাদেশে কৃষির বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা -ড. মো. আনোয়ার হোসেন.
বাংলাদেশের এনডিসি ২.০ বাস্তবায়নে জলবায়ু অর্থায়ন প্রাপ্তি প্রয়োজনের মাত্র ১.২৫%: এনডিসি ৩.০ এ পাঁচগুণ কার্বন নিঃসরণ কমানোর সম্ভাবনা শিল্পোন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অনুদানের ওপর নির্ভরশীল
বিএলআরআই আঞ্চলিক কেন্দ্র, সৈয়দপুর, নীলফামারী এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা
বিসিএস কৃষি ক্যাডার এসোসিয়েশনের কমিটি ঘোষণা
বাংলাদেশের Floriade Expo 2022 জয়