বাংলাদেশের কৃষি খাত দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০.০% কর্মসংস্থানের প্রধান মাধ্যম এবং জাতীয় জিডিপিতে এর অবদান প্রায় ১১.৩৮% (BBS, ২০২৪)। কৃষি খাত দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং আয়ের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, উর্বর ভূমি এবং ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি দেশকে একটি কৃষিপ্রধান জাতি হিসেবে পরিচিত করেছে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, শ্রমিক সংকট এবং ভূমি অবক্ষয় কৃষির উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়। বিশেষ করে, প্রকৃতির নানা অনিশ্চয়তা যেমন বন্যা, খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অব্যাহত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। যেহেতু কৃষি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একটি ভিত্তিসম্পদ, ভবিষ্যতে টেকসই কৃষির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
চ্যালেঞ্জ এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি উৎপাদনে স্থিতিশীলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চার কোটি ছয় লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎপাদক দেশ। দেশের গৃহস্থালির জন্য চালের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারত। তাছাড়া, গম, ভুট্টা এবং সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষকদের আয়ের উন্নতিও ঘটাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গম উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ১.২ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছেছে (AIS, ২০২৪)। এই বৃদ্ধি গমের স্থানীয় চাহিদা পূরণে যেমন সহায়ক, তেমনি দেশের খাদ্য উৎপাদনের বৈচিত্র্য বাড়ানোর ক্ষেত্রেও একটি অন্যতম নিয়ামক। এছাড়াও, ভুট্টা উৎপাদন ৫.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন (AIS, ২০২৪) এ পৌঁছেছে, যা খাদ্য এবং পশুখাদ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, দেশে গত বছর দানাদার খাদ্যের উৎপাদনে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ধান, গম, ভুট্টা মিলিয়ে মোট উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৪৩ হাজার টন। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ হয়েছে। সবজি উৎপাদনেও বিশাল উন্নতি হয়েছে, ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদিত সবজির পরিমাণ ছিল ২৪১.৭৮৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে প্রধান সবজি যেমন আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, শসা এবং গাজরের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কৃষকদের আয়ের বহুমুখীকরণ সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ কিছু বিশেষ ফসলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে এককভাবে রপ্তানির যোগ্যতা অর্জন করেছে, যা দেশের কৃষি খাতের একটি বড় সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে চিংড়ি, চা এবং আলু উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, বিশেষ করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কৃষকদের মাঝে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ২০২২-২৪ সালে, সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ১৫ ক্যাটাগরির ৫১,৩০০টি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেছে (DAE, ২০২৪)। এর মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শ্রমিক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, যেমন কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাওয়ার টিলার, রোটাভেটর, ট্রাক্টর ইত্যাদি কৃষকদের জন্য সময় ও শ্রম সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। উদাহরণস্বরূপ, একটি কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ১-১.৫ একর জমির ধান কর্তন, মাড়াই ও বস্তাবন্দি করা সম্ভব, যা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় প্রায় ৮০% সময় বাঁচায় এবং খরচ ৫০% পর্যন্ত কমিয়ে আনে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গবেষণা অনুসারে, যান্ত্রিক রোপণ ও কাটার ফলে ধানের উৎপাদনশীলতা ১০-১৫% বৃদ্ধি এবং ফসলের ক্ষতি ৫-৭% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এছাড়া, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে, কারণ এটি ফসল সংগ্রহের সময়সীমা কমিয়ে দ্রুত বোরো ও আমন চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে সাহায্য করছে। সার্বিকভাবে, সরকারের এই উদ্যোগ কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, ডিজিটাল কৃষি প্রযুক্তির প্রসার কৃষকদের জন্য তথ্যপ্রাপ্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। বর্তমানে, কৃষকরা মোবাইল অ্যাপ, SMS পরিষেবা, কল সেন্টার, রিমোট সেন্সিং এবং ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি পরামর্শ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, সার ও কীটনাশকের সঠিক মাত্রা এবং রোগবালাই দমন সম্পর্কিত তথ্য দ্রুত পাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ (যেমন, “Krishi Batayon”, “Soil Fertility App”) চালু করেছে, যা কৃষকদের মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা, উপযুক্ত ফসল নির্বাচন এবং সার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া, ‘৩৩৩১’ কৃষি হটলাইন এবং বিভিন্ন SMS পরিষেবা কৃষকদের দ্রুত সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে কীটনাশক প্রয়োগ, জমির স্বাস্থ্য নির্ণয় এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যদিও সীমিতভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে-এ বিষয়ে আরো ব্যাপকভিত্তিক কাজ করা প্রয়োজন। গবেষণা অনুসারে, ড্রোনের মাধ্যমে কীটনাশক প্রয়োগ প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ৬০-৭০% সময় সাশ্রয় এবং কীটনাশকের ব্যবহার ৩০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে কৃষি খরচ হ্রাসের পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকিও কমানো যাবে। ২০২৩ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে ধানক্ষেতে কীটনাশক ও সার প্রয়োগের সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে, যার গবেষণা এখনো চলমান। পাশাপাশি, উন্নতমানের স্যাটেলাইট ইমেজিং ও IoT (Internet of Things) সেন্সর ব্যবহার করে জলবায়ু ও মাটির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার কাজ শুরু হয়েছে, যা স্মার্ট কৃষির সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তুলছে। সার্বিকভাবে, ডিজিটাল কৃষির অগ্রগতি কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার পাশাপাশি ফসলের ফলন বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট নিরসন ও পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তারপরও এ দেশের কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, শ্রমিক সংকট এবং ভূমি অবক্ষয়ের মতো অন্তরায় প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের আয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের তাপমাত্রা প্রতি দশকে গড়ে ০.২-০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়তে পারে (World Bank, ২০২৪)। এর ফলে কৃষিজমির লবণাক্ততা, খরা, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা আরও বেড়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে সৃষ্ট প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ হলো- ১. সেচ সংকট ও পানি ঘাটতি: কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ২. লবণাক্ততার বৃদ্ধি: উপকূলীয় অঞ্চলে ২০ লাখ হেক্টর জমি লবণাক্ততার কারণে চাষের অনুপযোগী হয়ে উঠছে (BARI, ২০২৪)। ৩. বন্যা ও খরার প্রভাব: ২০২৪ সালে বন্যার কারণে ১.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল নষ্ট হয়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে (Reuters, ২০২৪)। ঘূর্ণিঝড় মোখা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষিজমি নষ্ট, এবং কৃষকের আর্থিক ক্ষতি করেছে (BMD, ২০২৪)। বজ্রপাত, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে আমন ও বোরো ধানের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৪. কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস: অত্যাধিক তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ধান, গম, ডাল ও সবজি উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পানির পুনঃব্যবহার প্রযুক্তি, গভীর নলকূপ, এবং স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে আধুনিক সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষতি পূরণের জন্য বিশেষ কৃষি বীমা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে কৃষকদের জন্য চালু করতে হবে। দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন, বিকল্প চাষাবাদ ও কৃষি ঋণ সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষক প্রশিক্ষণ জরুরি। কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতা বর্ধিত করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে বীজ, সার ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে। জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ লক্ষণীয়। বিশেষকরে, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন উল্লেখযোগ্য। কৃষি জমির স্বাস্থ্য নিরীক্ষা, কীটনাশক প্রয়োগ, এবং আগাম বন্যা ও খরা পূর্বাভাস দিতে ড্রোন ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষকদের জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থাপনা যেমন- জৈব কৃষি, মালচিং, শস্য বহুমুখীকরণ এবং সংরক্ষণমূলক চাষাবাদ প্রযুক্তি কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থায়ন এনে গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করতে হবে। সার্বিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি, যাতে বাংলাদেশ টেকসই কৃষি উৎপাদনে নেতৃত্ব দিতে পারে। সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের কৃষি খাতকে জলবায়ু সহনশীল করতে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিশেষভাবে, শ্রমিক সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষির আধুনিকায়নের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে শহরমুখী অভিবাসন ও কৃষি শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কারণে কৃষি খাতে শ্রম ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কৃষি শ্রমিক সংকটের হার ২৫% ছাড়িয়ে গেছে, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৩৫% হতে পারে (BIDS, ২০২৪)। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্ম কৃষি কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, ফলে বয়স্ক ও অভিজ্ঞ কৃষকরা উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেমন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ-যান্ত্রিক চাষাবাদ, রোপণ, ও ফসল কর্তনের জন্য আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার কৃষি খাতে শ্রমিক নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করছে। কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ৮-১০ জন শ্রমিকের কাজ মাত্র ১-২ জন চালকের সাহায্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে শ্রমিক সংকটের সময় ধান রোপণের জন্য কার্যকর সমাধান। রোটাভেটর ও পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে চাষাবাদ দ্রুত ও সহজতর করে শ্রমের চাহিদা কমিয়ে আনে। রোবটিক ও অটোমেশন প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে খুবই কার্যকর। অন্যদিকে, উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দেশের প্রায় ৬০% আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে (SRDI, ২০২৪)। তাই, জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধি, ফসল চক্র (Crop Rotation), এবং সংরক্ষণমূলক চাষাবাদ (Conservation Agriculture) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ১,০০০টি Soil Testing Kit বিতরণ করেছে, যা মাটির গুণগত মান বিশ্লেষণ করে সুষম সার প্রয়োগে সহায়ক সহায়ক ভূমিকা পালন করছে (DAE, ২০২৪)। ২০২৪ সালে জৈব সার ব্যবহারের হার ৪২% ছাড়িয়েছে (BBS, ২০২৪), যা আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। ভার্মি কম্পোস্ট, সবুজ সার ও গোবর সার ব্যবহারের ফলে মাটির জৈব উপাদান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করছে এবং রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে। মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নে বহুমুখী চাষাবাদ ও ফসল রোটেশন-ফসল রোটেশন ও বহুমুখী চাষ (Multi-Cropping) নীতি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে: ডাল, সরিষা, ও বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করে জমির নাইট্রোজেন ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব। একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষের ফলে যে মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা প্রতিরোধ করা যাবে। সুনির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক সার ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, যেমন Balanced Fertilizer Application System (BFAS), যা সারের অতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করবে বলে বিশ্বাস। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ৫০০ কোটি টাকার ভূমি সংরক্ষণ প্রকল্প চালু করেছে, যা উর্বর জমির অবক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক হবে (MoA, ২০২৪)।
সর্বোপরি, টেকসই কৃষির জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এখনই। কৃষি খাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সম্প্রসারণ অপরিহার্য। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষকের আয় বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই।
টেকসই কৃষির প্রধান অগ্রাধিকারসমূহ হলো- ১. বাংলাদেশ সরকার “স্মার্ট কৃষি” কর্মসূচি চালু করেছে, যার মাধ্যমে ১.৫ কোটি কৃষক ডিজিটাল সেবা পাবে (DAE, ২০২৪)। এই সেবা ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০% নিশ্চিত করতে হবে। ২. কৃষি বিষয়ক মোবাইল অ্যাপ ও SMS পরিষেবার মাধ্যমে কৃষকদের তাৎক্ষণিক পরামর্শ প্রদান- এটি জনপ্রিয় করে কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। ৩. ড্রোন প্রযুক্তি ও IoT ভিত্তিক স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে, যা সেচ ও সার প্রয়োগকে স্বয়ংক্রিয় করবে। ৪. জলবায়ু সহনশীল কৃষি গবেষণা উন্নয়ন করতে হবে। ৫. স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ৬. জৈব কৃষি ও পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তির প্রসার করতে হবে। ৭. আধুনিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সেবা চলমান রাখতে হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ৭০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে হবে। ৮. “স্মার্ট কৃষি বাজার ব্যবস্থা” চালু করেছে, যার মাধ্যমে কৃষকরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এটি বিস্তার ঘটাতে হবে এবং ই-কমার্স ও অ্যাগ্রিটেক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগকে কার্যকর করতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ু সহনশীল কৃষি সম্প্রসারণ ও গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করার পাশাপাশি কৃষকদের জন্য কৃষি বীমা ও সহজ ঋণ সুবিধা সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কৃষি খাত গত এক দশকে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, ডিজিটাল কৃষির সম্প্রসারণ এবং কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি এ উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে (EPB, ২০২৪)। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট, ভূমি অবক্ষয় এবং পানির স্বল্পতা ভবিষ্যতে টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকার, কৃষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা এবং প্রযুক্তিবিদদের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি টেকসই, উৎপাদনশীল এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর

বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৫ : আমাদের জীবনের বস্ত্র তুলা
Politics, Agriculture, Current Situation and Future Plans – Dr. Md. Anwar Hossain.
বাংলাদেশের এনডিসি ২.০ বাস্তবায়নে জলবায়ু অর্থায়ন প্রাপ্তি প্রয়োজনের মাত্র ১.২৫%: এনডিসি ৩.০ এ পাঁচগুণ কার্বন নিঃসরণ কমানোর সম্ভাবনা শিল্পোন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অনুদানের ওপর নির্ভরশীল
বিএলআরআই আঞ্চলিক কেন্দ্র, সৈয়দপুর, নীলফামারী এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা
মূল্য সংযোজন ও পুষ্টি উন্নয়নে সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের অপার সম্ভাবনা
Ensuring Fair Returns for Bangladeshi Potato Farmers in 2025: Challenges and Way forward – Dr. Md. Mahfuz Alam