কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটা শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। চালভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসে গড়ে উঠা প্রায় ১৭ কোটি মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যের যোগান দেয়া, বাজারে খাদ্যপণ্য সহজলভ্য করার প্রক্রিয়াটা এদেশের প্রেক্ষাপটে কঠিন ব্যপার। আয়তনে পৃথিবীর ৯২ তম (World Atlas) ও জনসংখ্যায় ৮ম স্থানে থাকা এ দেশটির জনগনের মাথাপিছু কৃষি জমি প্রায় ১২ শতাংশ (জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি হিসেবে)। যেখানে উন্নত দেশগুলিতে লক্ষ্য লক্ষ্য একর জমি বছরের পর বছর পড়ে থাকে সেখানে এখানকার জমিগুলির অর্ধেকের বেশি জমিতে বছরে ২টি ফসল চাষ হয়, এক চতুর্থাংশ জমিতে একটা ফসল এবং প্রায় ২৩ ভাগ জমিতে তিন ফসলের চাষ হচ্ছে। চলতি বা সাধারন নিয়মিত ফসল চাষের সাথে সাথে উচ্চমূল্যের বা বানিজ্যিক ফসলের চাষও বাড়ছে। এবারের লক্ষ্য হচ্ছে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়ন করে কৃষিপণ্যের শিল্পায়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশে যুব ও নারীসমাজের কর্মক্ষেত্র নিয়োগ বৃদ্ধি করা।
কৃষিকে বানিজ্যিকরণের সুফল ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষি কাজ লাভজনক হওয়ায় এখন অনেক শিক্ষিত তরুণ বা যুবক এবং বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা কৃষিতে বিনিয়োগ বা আত্মনিয়োগ করছেন। বিদেশে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা জানেন যে, উন্নত দেশগুলিতে যে ফল বা শাক-সবজির চাহিদা আছে বা যা তারা আমদানী করে, সেসকল ফল বা শাক-সবজি যা যা বাংলাদেশ বা এতদাঞ্চলে উৎপাদিত হয়, তার স্বাদ ও মিষ্টতা তুলনামূলক বেশি। যে কারনে বাংলাদেশে উৎপাদিত ফল-মূল- শাক-সবজি থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবারগুলির চাহিদা অন্যান্য দেশে অনেক বেশী। এখানেই একটা বড় সুযোগ আছে বিদেশে কৃষি পণ্য রফতানি করার, যার মাধ্যমে দেশে আসতে পারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য বা কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত। বর্তমান অবস্থায় বছরে প্রায় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি রপ্তানি হয়, যা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। উন্নত বিশ্বে এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ‘Ready to eat’ বা ‘Ready to cook’ পর্যায়ের খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই সকল প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য তৈরি না করে তারা আমদানি করে। এই বাজারগুলিতে প্রবেশ করতে পারলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য আমাদের কৃষিকে আরও বেশি বহুমুখীকরণ করে মানসম্পন্ন পণ্যের উৎপাদনমুখী হতে হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০২২ সালে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করা গেলে এই বাজারে প্রবেশের ভাল সুযোগ আছে বাংলাদেশী পণ্যের। রপ্তানিকারকদের সহায়তা দিতে ঢাকায় বৃহৎ আকারে আন্তর্জাতিক মানসম্মত অ্যাক্রিডিটেড পরীক্ষাগার দ্রুততার সাথে স্থাপন করার কার্যক্রম চলমান আছে। এটি চালু হলে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্য পণ্য ব্যবস্থাপনা ও ফাইটস্যানিটারি সার্টিফিকেট পেতে সহজ হবে। এ ছাড়াও মানসম্পন্ন কৃষিপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে উত্তম কৃষি চর্চার (GAP) সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক ও স্টেকহোল্ডারদেরকে GAP বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। সে সকল চাষী এবং রপ্তানীকারকরা বিষয়টি ভালভাবে চর্চা করে পণ্য উৎপাদন করেছেন তাদের পণ্য সহজেই বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশে উৎপাদিত আম ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন চেইনশপে বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কৃষিজাত যে সকল পণ্য রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো- পাট ও পাট প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য, যা বিদেশের সকলেরই ব্যবহারযোগ্য। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী বা উপমহাদেশীয় প্রবাসীদের ব্যবহারের জন্য কিছু চাল, শাকসবজি, আলু, পটল, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, পেঁপে, শিম, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, কচু, মুখীকচু এবং ফলমূলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, লটকন, আমড়া, পেয়ারা, শুকনা বরইসহ কিছু অপ্রচলিত ফলও রফতানি হয়। কিছু মসলা যেমন কালিজিরা, হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, বা আরও কিছু প্যাকেটজাত মসলা, তামাক, কিছু ফলের ড্রিংকস, ড্রাই ফুডসজাতীয় কিছু পণ্যও বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। ড্রাই ফুডসের মধ্যে বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পটেটো ক্র্যাকার ও বাদাম বেশী রফতানী হয়ে থাকে। এছাড়া কিছু শুকনা খাবার, যেমন-রুটি, লুচি বা পুরি বা সিঙ্গাড়া, বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং সুগার কনফেকশনারি বা জ্যাম-জেলির মতো কিছু পণ্যও রফতানি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রফতানির প্রধান গন্তব্য হলো মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চল। এসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশী ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরা হচ্ছেন মূল ভোক্তা। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে শাকসবজি রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও নেপাল। যেসব দেশে ফল রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। সারা দেশে অনেক ছোট ছোট প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা আছে। কিন্ত্ত তারা সকলেই বিদেশী ক্রেতাদের শর্তাবলী পূরণ করতে পারছে না বলে রপ্তানিও করতে পাচ্ছে না। বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান অবশ্য ১৪৪ টি দেশে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করছে বলে জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে একটি শক্তিশালী উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মাঠে কাচামালের উৎপাদন হতে শুরু করে বিপনন পর্যন্ত তারা কৃষক, কৃষি কর্মী ও ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত থেকে ব্যবসা করছে। ব্যবসায়ীদেরকে দেশি-বিদেশী নিয়মাবলী বুঝে বা অনুসরণ করে কাজে অংশ নিলে সারা বিশ্বে রপ্তানী বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। পণ্য বিপননে মোড়ক ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগী ও গুরুত্ব দিতে হবে। ‘আগে দর্শনধারি, পরে গুন বিচারী’ এই প্রবাদটা মাথায় রাখতে হবে। এটাকে অনুসরণ করে এবার বাংলাদেশের চায়ের বিক্রি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। দেশে গত কয়েকবছর চা রপ্তানি কমে গিয়েছিল। কারন অনুসন্ধানে রপ্তানিকারকগণ গবেষণা করে মোড়ক ব্যবস্থা উন্নত করে। খোলা চা বিক্রির পরিবর্তে মোড়কজাত করে চা বিক্রি করার পর এবছরের লক্ষমাত্রা গত ৮ মাসেই অর্জিত হয়েছে।
কৃষি পণ্য রপ্তানি নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের মধ্যে মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নতুন নতুন দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে যে দেশগুলোর সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে তার বাইরে আরও নতুন দেশে বাজার তৈরির প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বিশ্বের কোন দেশে কী ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে, তাদের শর্তাবলী বা আইন-কানুন কি তা জানা প্রয়োজন। বর্তমান খেলাধুলায় সাফল্য এবং গার্মেন্টস পণ্যের প্রসারে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ভাল ধারনা বিদেশীদের মাঝে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষি-শিল্পজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশ সুনাম অর্জন করেছে এবং কয়েকটি ব্র্যান্ড আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। যার ফলে ‘বাংলাদেশ ব্রান্ডের’ একটা বাজার তৈরি হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের আরও বহুমুখীকরণ করা গেলে, আরও নতুন বাজার সৃষ্টি হবে। অন্যান্য আরও কোম্পানি যদি মানসম্পন্ন পণ্য নিয়ে এগিয়ে যায় তবে বাংলাদেশী কৃষি পণ্যের ক্রেতা আরও বাড়তে থাকবে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারলে একদিকে কৃষকেরা লাভবান হবে, দেশে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, যুব সমাজ ও মহিলাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং সাথে সাথে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সময়োপযোগী, কার্যকর, বাস্তব পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাওয়াটাই এখন সময়ের ব্যপার ।

খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশে কৃষিই ভরসা -রাশমিয়া শামীম নিমিতা
বাংলাদেশে কৃষির বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা -ড. মো. আনোয়ার হোসেন.
Ensuring Fair Returns for Bangladeshi Potato Farmers in 2025: Challenges and Way forward – Dr. Md. Mahfuz Alam
Empowering Voices, Challenging Narratives -Dr. M Abdul Momin
আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ : নিরাপদ উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন
ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি : নারী ও শিক্ষিত তরুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি