বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেওয়া ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে রয়েছে। তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তার শিকার মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে-নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়া।
প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে বোঝানো হয়েছে ব্যক্তি বা পরিবারের পর্যায়ে অর্থ বা অন্যান্য সম্পদের অভাবে খাদ্যপ্রাপ্তির সীমিত সুযোগ। এতে বলা হয়েছে, শুধু খাদ্যনিরাপত্তার সংকটেই নয়, স্বাস্থ্যকর বা সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। বাংলাদেশে ৪৪ শতাংশের বেশি বা ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না এখনো। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত ওজন কম থাকার হার বাংলাদেশে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশে এ বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বকায় অন্তত ২৫ শতাংশ।
দীর্ঘকালীন অপুষ্টির কারণ মূলত খাদ্যগ্রহণ ও অসুস্থতার জন্য হয়ে থাকে, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের উপর প্রভাব রাখে। পুষ্টি ও স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চিতকরণ আবশ্যক। দেশের আইসিডিডিআরবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে ক্যানসার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ লোক খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রতিদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে অনিরাপদ খাদ্য ও পানি। থাইল্যান্ডের বামরুগ্রাড হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শতকরা ৫০ ভাগই বাংলাদেশি এবং এ সব রোগীদের বেশিরভাগই লিভার, কিডনি, প্রজনন সমস্যাসহ অন্যান্য জটিলতায় ভোগে; তার মতে ভেজাল খাদ্যগ্রহণ এ সব অসুস্থতার জন্য দায়ী। অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর খাদ্যে ভেজাল ও বিষক্রিয়ার কারণে লক্ষাধিক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এবং অনেকের মৃত্যু ঘটে। ডায়রিয়া, ক্যান্সার, কিডনিজনিত সমস্যা, প্রজনন অক্ষমতা এবং লিভারজনিত জটিলতার মতো রোগের পেছনে খাদ্যে ভেজাল একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তদুপরি এসব রোগের চিকিৎসায় ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়, যা পরিবারের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সব সময় সবার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সব নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জনগণ তাদের আয়ের বেশিরভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। এখানে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকাটা জরুরী।
খাদ্য নিরাপত্তার (Food security) অর্থ হলো অবাধ খাদ্য সরবরাহ এবং সারাবছর খাদ্যের পর্যাপ্ত প্রাপ্যতা ও মানুষের খাদ্য ভোগের অধিকার। কোন বাসস্থানকে তখনই “খাদ্য নিরাপদ” বলে মনে করা হয়, যখন এর বাসিন্দারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসবাস করে না কিংবা খাদ্যাভাসে উপবাসের কোন আশঙ্কা করে না।
খাদ্য নিরাপত্তায় তিনটি প্রধান বিষয় থাকে । প্রথম: একটি পরিবার ও জাতির প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রাপ্যতা। দ্বিতীয়: স্থানভেদে বা ঋতুভেদে খাদ্য সরবরাহের যুক্তিসঙ্গত স্থায়িত্ব। তৃতীয়:নির্বিঘ্ন ও মানসম্মত পরিমাণ খাদ্য প্রত্যেক পরিবারের ভৌত,সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবাধ অধিকারের নিশ্চয়তা। আবার পুষ্টি নিরাপত্তার শর্ত হচ্ছে- ১.পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্যের প্রাপ্যতা। ২.পুষ্টিকর পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি এবং খাবার সংগ্রহের দক্ষতা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান। ৩.স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সুবিধা বা খাদ্য গ্রহণের ফলে কার্যকর শরীর গঠনে ভূমিকা রাখে।
দেশে খাদ্য সরবরাহের মূল উৎস হলো কৃষি খাত (শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বন উপখাত নিয়ে কৃষি খাত গঠিত)। এ খাতটি এখন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জে পড়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জাতিসংঘের জলবায়ু প্যানেল (আইপিসিসি) বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসাবে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে ইউএনডিপি বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোনপ্রবণ এবং ষষ্ঠতম বন্যাপ্রবণ দেশ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে বৃষ্টিপাতে অস্বাভাবিকতা, বন্যা, ভূমিক্ষয়, জলাবদ্ধতা, অনাবৃষ্টি, খরা, টর্নেডো এবং সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও প্রসারতা, শীতের শৈত্যপ্রবাহ, ঘনকুয়াশা, আকস্মিক বন্যা কৃষিকে হুমকির মধ্যে ফেলেছ। যা খাদ্য নিরাপত্তাকে একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিয়ে এসেছে।
মূলতঃ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি, গুণগত মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণের যথাযথ ব্যবহার, বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহার যথেষ্ট অবদান রেখেছে, যা অধিকতর শক্তিশালীকরণ প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী অধ্যুষিত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষিকে লাভজনক পেশা হিসেবে গড়ে তোলা এবং উন্নত পুষ্টিমানসম্পন্ন নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা অর্জনে অনেকগুলো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যতম। এ সকল দুরূহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সকল অংশীজনের সুদৃঢ় ভূমিকা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সময়োপযোগী নীতিমালা, পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে আশু বাস্তবায়ন জরুরি। কৃষিখাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কৃষি খাতে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, কৃষি উপকরণ ব্যয়ের সহজলভ্যতার পাশাপাশি কৃষিজমির বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে বর্তমানে আর একটি কৃষি বিপ্লবের ডাক দিতে হবে। যেখানে খাদ্য-পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কার্যকর ও সম্ভাবনাময় লাগসই প্রযুক্তি/কৌশল কাজে লাগাতে হবে। একইসাথে দেশে উৎপাদন পরবর্তী ফসল ব্যবস্থাপনাকে সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম ঠিক করতে হবে।

বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৫ : আমাদের জীবনের বস্ত্র তুলা
বাংলাদেশে কৃষির বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা -ড. মো. আনোয়ার হোসেন.
Ensuring Fair Returns for Bangladeshi Potato Farmers in 2025: Challenges and Way forward – Dr. Md. Mahfuz Alam
Empowering Voices, Challenging Narratives -Dr. M Abdul Momin
ঘাটাইলে বারি সরিষা-১৮ মাঠ দিবস আয়োজিত